অচেনা বৃদ্ধ” হলো কালকেতু সমগ্র গল্পের পঞ্চম অংশ। এখানে কালকেতুর জীবনে নতুন রহস্যের দরজা খুলে যায়—যেখানে এক অদ্ভুত বৃদ্ধ তাকে অজানা সতর্কবার্তা দেয়। এই অধ্যায়েই স্পষ্ট হয়, কালকেতুর যাত্রা শুধু ভূতের সঙ্গে লড়াই নয়, বরং আরও গভীর ও অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হওয়া ।
চতুর্থ অংশ:-
কালীচরণ ঠাকুর
রাত অনেকটা গড়িয়ে গেছে। মীরার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে কালকেতু। তার মনে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে মীরার সেই ভাঙা কণ্ঠস্বর, যেটা সে স্পষ্ট শুনেছিল—“
সে আমার জিনিস নিয়েছে… ফেরত দাও…”চাঁদের আলো মেঘের আড়াল থেকে কখনো উঁকি দিচ্ছে, কখনো মিলিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের সরু মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছে কালকেতু, চারপাশে ঝিঁঝিঁর ডাক আর হাওয়ার ঝিরঝির শব্দ। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, পেছনে কেউ হাঁটছে।
সে ঘুরে তাকাল—শূন্য।কয়েক পা এগোতেই একেবারে পথের ধারে, অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বসে আছেন এক অচেনা বৃদ্ধ। সাদা চুল কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে এসেছে, দাড়ি কোমর পর্যন্ত। চোখদুটো গভীর, কিন্তু মাঝে মাঝে তাতে অদ্ভুত আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছে, যেন আগুন আর ছায়া একসাথে নেচে উঠছে।কালকেতু থমকে দাঁড়াতেই বৃদ্ধ মৃদু গলায় বললেন—“
মীরার কণ্ঠ তুমি শুনেছ, তাই না? সব শুনে ফেলেছ… কিন্তু শোনো, সবটা বুঝতে এখনো অনেক বাকি।”কালকেতুর বুক ধড়ফড় করছে। সে জিজ্ঞেস করল—“আপনি… কে? আর এসব কথা জানেন কীভাবে?”বৃদ্ধ হেসে উঠলেন, সেই হাসি কানে বাজল কর্কশ বাঁশির সুরের মতো।“আমি নামহীন… আমি ছায়া, আমি সীমান্তের মানুষ। তোমরা যখন ঘুমোও, আমি জেগে থাকি।

মীরা যে বিপদের মধ্যে আছে, তাতে শুধু সে নয়—তুমিও জড়িয়ে পড়েছ। পূর্ণিমা আসছে… আর তখন সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে।”বৃদ্ধ ধীরে ধীরে হাত তুললেন। তার আঙুলগুলো লম্বা, শুকনো, অস্বাভাবিকভাবে বাঁকা। বাতাস যেন হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল।তিনি বললেন—“এই তাবিজ রাখো। আলো আর অন্ধকার মিললে এর দরকার হবে। কিন্তু সাবধান, একে ব্যবহার করতে শিখতে সময় বেশি নেই।”
বৃদ্ধ কালকেতুর দিকে একটি ভাঙা তামার তাবিজ ছুঁড়ে দিলেন। তাতে খোদাই করা প্রতীকগুলো ম্লান আলোতেও জ্বলজ্বল করছিল।কালকেতু তাবিজটা হাতে নিয়েই একবার পলক ফেলল। আর চোখ খুলতেই দেখল—গাছের গোড়ায় কেউ নেই। বৃদ্ধ অদৃশ্য। শুধু শীতল বাতাসের ঝাপটা বয়ে গেল।কালকেতুর গায়ে কাঁটা দিল। সে বুঝল, ঘটনাটা মীরার বাড়িতে শেষ হয়নি—বরং এখনই প্রকৃত শুরু।
কালকেতু তাবিজটা মুঠোয় চেপে ধরে হাঁটা শুরু করল। কিন্তু অদ্ভুত এক ভারী অনুভূতি তার শরীরকে ঘিরে ধরল। মনে হচ্ছিল, যেন চারপাশের অন্ধকার তার দিকে ঝুঁকে আসছে, আর প্রতিটি গাছপালা তার দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ পায়ের নিচে শুকনো পাতা কচমচ শব্দ করল, আর সেই শব্দে যেন গোটা বন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দূরে এক শেয়ালের হাহাকার ভেসে এল, কিন্তু তাও কিছুক্ষণ পর নিঃশব্দ। কালকেতু বুঝল, এ নৈঃশব্দ্য স্বাভাবিক নয়—এ যেন অপেক্ষা করছে কিছু ঘটনার জন্য।সে থেমে গিয়ে তাবিজটা আলোয় তুলল।

প্রতীকের রেখাগুলো স্পষ্ট জ্বলতে শুরু করেছে, যেন নিজের থেকে আলো বেরোচ্ছে। ঠিক তখনই মৃদু ফিসফিসানি শোনা গেল—“তোমার সময় সীমিত… আলোকে আঁকড়ে ধরো, নইলে ছায়াই তোমাকে গ্রাস করবে।”কালকেতুর বুক কেঁপে উঠল। সে চারদিকে তাকাল, কিন্তু বৃদ্ধকে আর কোথাও দেখা গেল না। অথচ মনে হচ্ছিল, বৃদ্ধের দৃষ্টি এখনো তার উপর গেঁথে আছে।রাস্তার শেষে গ্রাম দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে যতটা সময় লাগার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি লাগছিল।
যেন পথটা লম্বা হয়ে যাচ্ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে। কালকেতুর মনে হলো, সে এক অদৃশ্য গোলকধাঁধায় আটকা পড়েছে।তখনই তাবিজের ভেতর থেকে ক্ষীণ আলোকরেখা বেরিয়ে তার সামনে পথ দেখাতে লাগল।কালকেতু হাঁটা শুরু করল… আর সে জানত, এ পথ তাকে কেবল ঘরে ফিরিয়ে দেবে না—এ পথ তাকে নিয়ে যাবে রহস্যের গভীরে।
পঞ্চম অংশ :
1 thought on “কালকেতু সমগ্র”