কন্যাদান-পঞ্চম পর্ব

এটি গল্প কন্যাদান-এর পঞ্চম অংশ। এর আগে স্কুলমাস্টারের পরিবার শ্রাবণীর জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসে—সরল-সোজা মানুষ, কোনো দাবি-দাওয়া নেই, শুধু সহজ সংসারের প্রতিশ্রুতি। তিন মাস পরেই সেই প্রস্তাব বিয়েতে পরিণত হলো। এবার শ্রাবণীর জীবনে অপেক্ষা করছে নতুন অধ্যায়—আলো ঝলমলে আচার-অনুষ্ঠান, আত্মীয়স্বজনের আশীর্বাদ, আর বিদায়ের মুহূর্তের অশ্রু মিশ্রিত আবহ।

কন্যাদান এর চতুর্থ পর্ব:

https://bangla.riseofthetimelords.com/%e0%a6%95%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%a8-2/

কন্যাদান

(বিবাহ পর্ব)

স্কুলমাস্টারের পরিবারের সঙ্গে বৈঠকের প্রায় তিন মাস পরেই বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হলো। শ্রাবণীর বাবা নীরবে সব আয়োজন মেনে নিলেন। তিনি জানতেন, এটাই গ্রাম্য সমাজের নিয়ম—মেয়েকে বিদায় দিতে হবে, নিজের মনের কথা বলার জায়গা নেই। মা একইভাবে ঠান্ডা চোখে প্রস্তুতি তদারকি করলেন, যেন দীর্ঘ অভ্যাস থেকে তৈরি এক নিঃশব্দ কর্তব্য।আশ্বিনের পর শীতের শুরুতে, পৌষ মাসে বিয়ের দিন ঠিক হলো। গ্রামের উঠোন ভরে উঠল আলো আর কোলাহলে।

আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করলেন; কেউ হাসিমুখে বললেন, “এবার কিন্তু মেয়েটাকে সত্যিই ঘরে তুলছে এক ভদ্র পরিবার।” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল, “স্কুলমাস্টার ছেলে, সংসার চালাতে কষ্ট হবে না।”শ্রাবণী সেজে উঠল লাল বেনারসি, কপালে সিঁদুরের আঁচল, গলায় সোনার মালা। আয়নায় নিজেকে দেখে বুক কেঁপে উঠল।

সে ভাবল, “এই রঙিন সাজ কি আমার স্বপ্নের রঙ ঢেকে দেবে? নাকি এখানেই নতুনভাবে শুরু হবে জীবন?”বরযাত্রীরা সন্ধ্যার আগে এসে পৌঁছালেন। ড্রাম, শাঁখ আর উলুধ্বনিতে ভরে উঠল বাতাস। স্কুলমাস্টার বর হিসেবে খুব সাধারণ—সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, শান্ত মুখে বসে আছেন। কারও চোখে তিনি ধনী নন, কিন্তু অনেকেই ফিসফিস করে বলল, “ভদ্র, শিক্ষিত ছেলে।

সংসারে শান্তি থাকবে।”

বিয়ের আসরে শুরু হলো আচার। ফুলশয্যার মতো গন্ধে ভরে উঠল উঠোন। পুরোহিত মন্ত্র পড়তে লাগলেন, আর চারপাশে জ্বলে উঠল প্রদীপ। শ্রাবণী কাঁপা হাতে মালা ধরল, তার চোখে জল জমে উঠছিল। স্কুলমাস্টার নীরবে তার দিকে তাকালেন, মুখে কোনো অহংকার নেই—বরং এক নরম আশ্বাস যেন লুকিয়ে ছিল।

কন্যাদানের সময় শ্রাবণীর বাবা মেয়ের হাত বর-এর হাতে রেখে বললেন,“আজ থেকে ওর সমস্ত দায়িত্ব তোমাদের।”কণ্ঠে ছিল চাপা কান্না, কিন্তু চোখে কোনো অশ্রু প্রকাশ পেল না। মায়ের ঠান্ডা দৃষ্টি এসময়ও অপরিবর্তিত, তবে অন্তরে ঢেউ উঠছিল—কেউ বুঝতে পারল না।আত্মীয়স্বজন আশীর্বাদ করতে এগিয়ে এলেন। কেউ বললেন,“সুখে থেকো, সংসারটা সুন্দর করো।”কেউ আবার বললেন,“শিক্ষিত পরিবারে যাচ্ছো, ভাগ্য খারাপ হবে না।”

কেউ গলা মিলিয়ে হেসে উঠলেন, “ছেলেটা ভদ্র, শান্ত—মেয়েটা ভালোই থাকবে।”শ্রাবণী সবার কথা শুনছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন তার কানে বাজছিল অন্য এক সুর—নিজের স্বপ্নের সুর। রঙতুলির গন্ধ, বইয়ের পাতার মলাট, আঁকাআঁকির অনন্ত টান। সেই স্বপ্নগুলো কোথায় যেন দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। তবুও সমাজের রীতির সামনে সে নির্বাক।সপ্তপদী সম্পন্ন হলো, মন্ত্র ধ্বনিতে আশেপাশের বাতাস ভারী। মেয়েরা উলুধ্বনি দিল, পুরুষেরা ধূপজ্বালানো হাতে আশীর্বাদ জানালেন।

বিয়ের পর যখন বিদায়ের মুহূর্ত এল, শ্রাবণীর বুক যেন ফেটে যাচ্ছিল। বাবা মুখ ফিরিয়ে নিলেন, মা চুপচাপ কপালে চুমু খেলেন।“ভালো থেকো মা,”—এটাই ছিল বাবার শেষ বাক্য।“তুমি এখন অন্যের ঘরের আলো,”—মা ধীর গলায় বললেন।শ্রাবণী গাড়িতে উঠে বসলো, লাল শাড়ির আঁচলে চোখ ঢেকে নিল। চারপাশের হইচই, আশীর্বাদ আর আনন্দধ্বনি—সবই যেন তার কানে মিশে যাচ্ছিল অদ্ভুত এক শূন্যতায়।এভাবেই শেষ হলো শ্রাবণীর বিয়ে। সমাজ, পরিবার আর নিয়মের বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেল তার জীবন।

আশীর্বাদের ঢেউয়ের ভেতরেও লুকিয়ে রইল এক অদৃশ্য প্রশ্ন—

এই কন্যাদান কি তাকে মুক্তি দিল, নাকি কেবল এক নতুন শেকলের ভেতরে ঠেলে দিল?

যদি আপনার আসে পাশে এমন কোনো মেয়ে থাকে তাহলে তার সাহায্য করুন:

https://devipeethindia.com/

Leave a Comment

error: Content is protected !!